ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো জানার আগে, আমরা জেনে নেই ক্রেডিট কার্ড এবং ক্রেডিট লিমিট কি?
ক্রেডিট কার্ড এবং ক্রেডিট লিমিট কি?
ক্রেডিট কার্ড হলো এক ধরনের চিপ যুক্ত প্লাস্টিক কার্ড। এই প্লাস্টিক কার্ড এর বহিরাংশে কার্ড সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, কার্ড ব্যবহারকারীর নাম, কার্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, কার্ডের ধরণ,ব্যবহারকারীর স্বাক্ষর, এবং কাস্টমার কেয়ারের বিবরণী সহ ইত্যাদি দেওয়া থাকে। সহজ ভাষায় ক্রেডিট কার্ড হল যে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত একটি কার্ড, যা ব্যবহারকারীকে আর্থিক ঋণ প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারকারীর আর্থিক ব্যায়ের অগ্রিম আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করে। অর্থাৎ, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করলে ব্যবহারকারীর ব্যাংক একাউন্ট থেকে কোনো রকম অর্থ কেটে নেয়া হয় না। তবে মাস শেষে খরচ অনুযায়ী ব্যবহারকারীকে প্রদত্ত ব্যাংকে সেই অর্থ পরিশোধ করতে হয়।
আপনার যদি একটি ক্রেডিট কার্ড থেকে থাকে এবং সেই কার্ড ব্যবহার করে আপনি যদি কেনাকাটা কিংবা কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন করে থাকেন, তাহলে আপনি যেই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছেন, একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে সেই একই পরিমাণ অর্থ আপনাকে ব্যাংকে পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে সেই ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত কিছু সুদ আপনার সেই খরচের সাথে যোগ হতে পারে।
ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার যোগ্যতা।
ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় একটি প্রশ্ন হলো, আপনি ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার উপযুক্ত কিনা কিংবা ব্যাংক আপনাকে ক্রেডিট কার্ড দেওয়ার জন্যে উপযুক্ত ব্যক্তি মনে করছেন কিনা। সাধারণত একজন ব্যক্তির মাসিক আয়ের উপর নির্ভর করে সেই ব্যক্তিকে ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড সুবিধা দিয়ে থাকে। আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেন, তা শোধ করার সক্ষমতা রাখেন, তবেই ব্যাংক আপনাকে ক্রেডিট কার্ডের জন্যে উপযুক্ত ব্যক্তি মনে করবেন।
ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য কি কি কাগজপত্র প্রয়োজন?
আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য আপনার কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে। আপনি যদি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন তাহলে নিম্নোক্ত কাগজপত্র গুলো থাকলেই আপনি ক্রেডিট কার্ড নিতে পারবেন।
১। জাতীয় পরিচয়পত্র
২। টিআইএন সার্টিফিকেট
৩। যারা চাকরিজীবী তাদের ক্ষেত্রে চাকরিতে যোগদানের প্রমাণপত্র, আয়ের সনদ এবং তিন মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট।
৪। যারা ব্যবসায়ী তাদের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স, এবং মেমোরেন্ডাম অব এসোসিয়েশনের ৩ মাসের ব্যাংক ট্রানজেকশন স্টেটমেন্ট।
এছাড়াও যে অর্থনৈতিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আপনি ক্রেডিট কার্ড নিতে চাইছেন, সেখানে আপনার কোনো স্থায়ী আমানত থাকলেও আপনি সেখানে কার্ডের জন্যে আবেদন করতে পারবেন।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা গুলো কি কি? Benefits of using credit cards
✔️ অগ্রিম ঋণের সুবিধাঃ
কিছু কিছু কার্ড আপনাকে ঋণের সুবিধা প্রদান করবে। বিশেষ করে বিদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে শূন্য শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়। আর প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাংককে প্রদান করা লাগে। কিছু কিছু ব্যাংকে আবার অনেক কম সুদের হারে ঋণ দেওয়া হয়। এটিও একদিক দিয়ে ব্যবহারকারীর উপর ভালো প্রভাব ফেলে। ব্যবহারকারী বাড়তি খরচের বোঝা এড়াতে সময়মতো ঋণ শোধ করে থাকেন। যে কারণে তার কোনো বকেয়া থাকেনা।
✔️ দ্রুত লেনদেনঃ
ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দ্রুত লেনদেন। ক্রেডিট কার্ড হাতের কাছে থাকায় যেকোনো অর্থনৈতিক লেনদেন মুহূর্তেই সম্পন্ন করা সম্ভব। ধরুন, রাস্তায় হাঁটার সময় আপনার মনে হলো, কোনো একটি পণ্য কেনা প্রয়োজন। কিন্তু সেই মুহূর্তে আপনার হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। আপনার যদি একটি ক্রেডিট কার্ড থেকে থাকে, তাহলে টাকা নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। কারণ, আপনি চাইলেই সেই ক্রেডিট কার্ডটি ব্যবহার করে, আপনার কাঙ্খিত পণ্যটি কিনে ফেলতে পারেন।
✔️ সহজেই পরিবর্তনযোগ্যঃ
ক্রেডিট কার্ড সহজেই পরিবর্তনযোগ্য। আপনার ক্রেডিট কার্ডটি কোনোভাবে হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গেলে আপনি সেটি পরিবর্তন করতে পারেন। অথবা আপনি যদি কোনো একটি অফারের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে থাকেন এবং আপনার মনে হয় যে এই কার্ডটি পরিবর্তন করে আপনি অন্য কোন অফারের কার্ড ব্যবহার করবেন, তাহলে খুব সহজেই আপনি আপনার কার্ডটি পরিবর্তন করতে পারবেন।
✔️ ব্যয়ের সঙ্গে আয়ঃ
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে ব্যবহারকারী এই সুবিধাটিও পেয়ে থাকেন। ক্রেডিট কার্ড সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রায়ই কিছু অফার দিয়ে থাকে। যেমন, “ক্যাশব্যাক অফার” অথবা “স্পেশাল ডিসকাউন্ট”। এই অফারগুলো দেওয়া হয় আপনার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে। আপনি যত বেশি ব্যয় করবেন, ততবেশি এই অফারগুলো গ্রহণ করতে পারবেন। এতে করে আপনার ব্যয়ের সাথে আয়ের রাস্তাটাও সহজ হয়ে যায়।
✔️ খরচের হিসেব রাখাঃ
ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান আপনার প্রত্যেকটি লেনদেনের হিসেব রাখে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আপনার করা যেকোনো লেনদেনের সময়, স্থান, পরিমাণ ইত্যাদি সকল প্রকার তথ্যই সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকে। এ কারণে আপনি নিজের পরিকল্পনা মাফিক খরচ করতে পারেন।
✔️ নগদ অর্থ বহন করা লাগেনাঃ
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে আপনার কোন নগদ অর্থ বহন করতে হবেনা। আপনি চাইলেই ‘নগদ অর্থ ছাড়াই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করতে পারবেন। তাই এক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার অত্যন্ত সুবিধাজনকার
✔️ কিস্তিতে পণ্য কেনাঃ
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আপনি দামী বিভিন্ন পণ্য কিস্তিতে কেনার সুযোগ পাবেন। যেসব পণ্যের দাম অনেক বেশি, সেসব পণ্য দীর্ঘ মেয়াদে ছোট ছোট কিস্তিতে নেওয়ার সুযোগ করে দেয় ক্রেডিট কার্ড।
আমরা যদি একটু চেষ্টা করি আমাদের অতিরিক্ত ব্যয় কমিয়ে আনতে পারি, এবং ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা সঞ্চয় ও করতে পারি। আজকে আমরা বর্তমান পরিস্থিতিতে অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত ব্যয় কমিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা সঞ্চয় কিভাবে করব তার ওপরে কিছু টিপস নিয়ে আলোচনা করব। আসুন টিপস গুলো জেনে নেওয়া যাক।
✔️ নিরাপত্তাঃ
নগদ, ডেবিট কার্ড কিংবা চেক ব্যবহারের চেয়েও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা অনেকটাই নিরাপদ। কারণ ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের লেনদেন নিরাপদ করার জন্যে অনেক ধরণের ব্যবস্থাই গ্রহণ করে থাকেন। কোনো কারণে যদি ক্রেডিট কার্ডে অনাকাঙ্ক্ষিত লেনদেন ঘটে থাকে এবং গ্রাহক সেটি ব্যাংককে জানায়, তাহলে ব্যাংক সেই কার্ডের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং গ্রাহককে নতুন একটি কার্ড দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে কোনো ভাবে আপনার কার্ড হারিয়ে গেলে কিংবা চুরি গেলে এবং চুরি হয়ে যাওয়া সেই কার্ড থেকে যদি কোনো টাকা উত্তোলন হয়, তাহলে . উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে সেই টাকা ব্যাংক গ্রাহককে দিতে বাধ্য থাকে। আর একারণেই অনেকেই মনে করেন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা নিরাপদ।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের অসুবিধা গুলো কি কি?
✔️ সঠিক কার্ড না চেনাঃ
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে সঠিক কার্ডটি বেছে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আপনি যদি একটি ভুল কার্ড দিনের পর দিন ব্যবহার করতে থাকেন, তাহলে আপনার ঋণের বোঝা বাড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। একারণে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের পূর্বে এর শর্তাবলি ঠিকভাবে বুঝে পড়ে নিতে হবে।
✔️ উচ্চ মূল্যের লেনদেন ফিঃ
ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি পরিমাণে বাড়তি ফি থাকে। যা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের একটি অসুবিধা। লেনদেনে এই বাড়তি ফি এর কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারীকে তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়।
✔️ লুকানো ব্যয়ঃ
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে শুধুমাত্র ব্যাংকের নির্ধারিত সুদের হারই একমাত্র ব্যয় নয়, এটি ছাড়াও ক্রেডিট কার্ডে আরো বেশ কিছু লুকোনো ব্যয় থাকে। আপনি যদি মাস শেষে সঠিক সময়ে ব্যাংকের বকেয়া পরিশোধ না করতে পারেন, তাহলে আপনাকে জরিমানা গুনতে হতে পারে। ক্রেডিট লিমিট অতিক্রম করে খরচ করলেও তার জন্যে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে আপনাকে। এজন্য পরিকল্পিত ব্যয় ছাড়া ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে আপনার ঋণের সাথে আরো অধিক হিডেন চার্জ যোগ হয়ে বিশাল অংকের ব্যয় বহন করতে হতে পারে।
✔️ নূন্যতম বকেয়ার ফাঁদঃ
ক্রেডিট কার্ডের বিল তৈরীর সময় ব্যাংক বিলের শীর্ষে নূন্যতম বকেয়ার একটি পরিমাণ উল্লেখ করে দেন। অনেক ব্যবহারকারীই মনে করেন, এটিই তার মোট বকেয়ার পরিমাণ এবং এই অর্থটিই তাকে ব্যাংকে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি সর্বনিম্ন একটি পরিমাণ, যেটি আপনার পরিশোধ করতে হবে ক্রেডিট কার্ডের পরবর্তী সেবা পাওয়ার জন্যে।
✔️ ঋণের ফাঁদঃ
ক্রেডিট কার্ড হলো একটি ঋণের মাধ্যম। আপনি প্রতি মাসে যেকোনো একটি আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তা ব্যবহার করবেন, এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে সেই অর্থ ফেরত দেবেন। তবে এতে সবসময় ঋণ বেড়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। কারণ, সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করলেই আপনার ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।
✔️ ক্রেডিট কার্ডের অত্যধিক ব্যবহারঃ
ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন সহজ হওয়ায় এবং যেকোনো সময় চাইলেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারায় একজন ব্যবহারকারী অনেক বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে তার ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতে পারে এবং সেই অনুযায়ী তাকে অতিরিক্ত সুদও প্রদান করতে হবে।
সর্বশেষ কথা
এতক্ষণ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা গুলো জানলে। সর্বোপরি একটি কথা মনে রাখতে হবে, ব্যাংক আপনাকে অগ্রিম টাকা দিচ্ছে ব্যবহার করার জন্য, সেটা কিন্তু এমনি এমনি নয়! এখানে আপনার কাছ থেকে বড় অঙ্কের একটি মুনাফা নিবে। তবে হ্যাঁ, ক্রেডিট কার্ডের কিছু মুনাফা এবং ক্রেডিট কার্ড চার্জ পয়েন্ট অর্জনের মাধ্যমে এড়ানো যায়। যদি একটু অসতর্ক হয়ে যান, তাহলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। যদি একান্ত প্রয়োজন না হয় তাহলে ক্রেডিট কার্ড না ব্যবহার করাই ভালো।